চট্টগ্রাম: আল্লামা অধ্যক্ষ জালালুদ্দীন আল কাদেরী।
১৯৭১ সালের ৭ জুন দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া
আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮০ সাল
থেকে এ মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। ১৯৮৬ সালে
নগরীর জমিয়াতুল ফালাহ জাতীয় মসজিদের খতিব হিসেবে যোগদান করে দায়িত্ব পালন
করে চলেছেন। দায়িত্ব পালনকালে খ্যাতি পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ হিসেবে
পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। এ পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জামেয়া মাদ্রাসা
তিনবার দেশের শ্রেষ্ঠ মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর জালালুদ্দীন আল কাদেরী
শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ মাদ্রাসা বোর্ডের
সদস্য ও শীর্ষ স্থানীয় এ আলেমসহ চট্টগ্রামের ১০ আলেমকে হত্যার পরিকল্পনা
করে জামায়াত শিবির। ইসলামের নামে জামায়াতে ইসলামীর সহিংস রাজনীতি, মানুষ
হত্যা, দেশের সম্পদ নষ্ট নিয়ে কোরান-হাদিসের আলোকে ইসলামের মূল বাণী কী তা
নিয়ে জালালুদ্দীন আল কাদেরী কথা বলেছেন বাংলানিউজের সঙ্গে। দেলাওয়ার
হোসেন সাঈদী তথাকথিত ‘তাফসিরুল কোরান’ মাহফিলের নামে শুরু থেকেই কোরান
হাদিসের অপব্যাখ্যা করায় চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এই জালালুদ্দীন আল কাদেরীসহ
চট্টগ্রামের চারজন শীর্ষ আলেম।
তারা সাঈদীকে কোরান-হাদিসের
অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে অভিযোগ করে আলোচনায় বসার জন্য লিখিতভাবে জানালেও
বৈঠকে বসেননি তিনি। বরং উল্টো বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদকারী এসব আলেমদের উপর
হামলা করেছে জামায়াত-শিবির।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, “দেলাওয়ার
হোসেন সাঈদী বিভিন্ন মাহফিলে(ধর্মীয় সভা) ইসলামের অপব্যাখ্যা করায় কোরান
হাদিস নিয়ে বৈঠকে বসার জন্য ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলাম। আলোচনায় বসার
জন্য চট্টগ্রামের শীর্ষ চারজন আলেম স্বাক্ষরিত একটি লিখিত আবেদনও তার কাছে
পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত তিনি কোন জবাব দেননি।”
মাওলানা
কাদেরী জানান, ‘তাফসিরুল কোরান” মাহফিল নাম দিয়ে সেখানে কোরান হাদিসের
অপব্যাখ্যা করায় ১৯৮১ সালের দিকে (যখন সাঈদী ওয়াজ শুরু করেছেন) এই
চ্যালেঞ্জ করেছিলাম আমরা।
চ্যালেঞ্জ করা চারজন আলেমদের মধ্যে সম্প্রতি হত্যার জন্য বাসায় রেকি করতে যাওয়া মুফতি ওবায়দুল হক নঈমীও ছিলেন।
জালালুদ্দীন
বলেন, “সাঈদী কোরান হাদিসের ব্যাখ্যার নামে ভুল ব্যাখ্যা করে সমাজে
বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আসছেন। ধর্মের নামে মুসলমানদের মাঝে বিভ্রান্তি
ছড়াতেন উত্তেজনামূলক রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে।”
কোরান-হাদিসের আলোকে
জামায়াত শিবির নেতারা সুন্নি আলেমদের সঙ্গে আলোচনায় বসার সাহস না থাকায়
তাদের হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে হত্যা পরিকল্পনা:
চট্টগ্রামের শীর্ষ দশজন আলেমকে হত্যার মাধ্যমে জামায়াত-শিবির রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চেয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন জালালুদ্দীন।
তিনি
বলেন, “হিটলিস্টভুক্ত ১০জন আলেমকে হত্যা করা হলে দেশের মানুষের মধ্যে বড়
ধরণের প্রভাব পড়তো। ফলে সরকার পড়তেন বেকায়দায়। আর এ সুবিধা নিতেন
পরিকল্পনাকারীরা।”
তিনি বলেন, “আমরা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত
নই। তবে সব সময় সরকারকে সহযোগিতা করে আসছি। যারা আল্লাহ এবং তার নবীকে নিয়ে
অবমাননাকর বক্তব্য দেয় তাদের বিরোধীতা করি।”
এ ঘটনার পর থেকে সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরণের সহযোগিতা পাওয়াতে ধন্যবাদ জানান তিনি।
ধর্মের নামে অধর্ম প্রচারে জামায়াত:
জামায়াতে
ইসলাম ধর্মের নামে অধর্ম প্রচার করছে বলে মন্তব্য করেছেন জালালুদ্দীন আল
কাদেরী। তিনি বলেন, ইসলাম হলো শান্তির ধর্ম। তারা যদি ইসলামের কথাই বলে
তাহলে মানুষ হত্যার কথা নয়।
তিনি জানান, জামায়াতে ইসলামের
প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদি নবী এবং সাহাবায়ে কেরাম নিয়েও অবমাননাকর
বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত সব সময় তার বিরোধীতা করে
আসছে।
তিনি বলেন, “যে দলের প্রতিষ্ঠাতা নবীর শানে বেয়াদবী করেছে
তার মতাদর্শের দল নবীর মর্যাদার কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। মানুষ
মারছে, হত্যার পরিকল্পনা করছে, বিরোধীদের মতাদর্শের লোকজনকে হত্যা করছে।”
“তারাতো মূলত ধর্মের নামে অধর্মই প্রচার করছে,” যোগ করেন তিনি।
সংখ্যা লঘু রাষ্ট্রের আমানত:
ইসলামী
রাষ্ট্রেও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী থাকলে তাদের হত্যা, নির্যাতন বা নাগরিক
অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোন বিধান ইসলামে নেই বলে জানান অধ্যক্ষ আল্লামা
জালালুদ্দীন আল কাদেরী।
তিনি বলেন, “রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিকের
অধিকার সমান। আর তাই রাষ্ট্রে সংখ্যা লঘুদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের।
কারণ সংখ্যা লঘু সম্প্রদায় হলো রাষ্ট্রের আমানত।”
তিনি মহানবী (সা.) বিদায় হজ্বের ভাষণের উদৃতি দিয়ে বলেন, “মহানবী (সা.) বিদায় হজ্বের ভাষণে কারো উপর নির্যাতনকে হারাম করেছেন।”
“ভিন্ন মত পোষণ করলেও কারো উপর জুলম-অত্যাচার- নির্যাতন করা যাবে না।”
ইসলামে হত্যার বিধান নেই:
ইসলাম
ধর্মে হত্যার কোন বিধান নেই বলে জানিয়ে নগরীর জমিয়াতুল ফালাহ জামে মসজিদের
খতিব জালালুদ্দীন বলেন, “শুধু মানুষ নয় ইসলাম ধর্মে কোন পশু পাখি হত্যারও
বিধান নেই।”
যারা ইসলাম ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করে, মানুষের জান
মালের ক্ষতি করে, দেশের সম্পদ নষ্ট করে তারা ইসলাম বুঝে না। বরং ইসলামের
নামে রাজনীতি করে ইসলামকে কলঙ্কিত করছে।
ইসলাম শান্তির ধর্ম
আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “আমরা সুফিবাদে বিশ্বাসী। আমরা সেই ইসলামের চর্চা
করি যেখানে মারামারি, হানাহানি নেই। যারা এর বিরোধীতা করে তাদের সঙ্গে
কোরান হাসিদের আলোকে কথা বলি।”
জামায়াত ইসলাম বিরোধী আকিদা (বিশ্বাস) পোষণ করে বলেই আমরা প্রতিবাদ করেছি। তাই আমাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, বলেন জালালুদ্দিন।
ইসলামে গুজব হারাম:
চাঁদে
সাঈদীর ছবি দেখার বিষয়ে তিনি বলেন, “চাঁদ এবং সূর্য হলো আল্লার কুদরতের
নিদর্শন। সেখানে কারো ছবি দেখা যাওয়ার ঘটনা নিতান্তই গুজব ছাড়া আর কিছু নয়।
আর গুজব ইসলাম ধর্মে সম্পূর্ণ হারাম।”
তিনি বলেন, ইসলামের ভুল
ব্যাখ্যা করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে
সাধারণ মানুষকে সহিংস ঘটনার সঙ্গে জড়ানো হচ্ছে। যা ইসলামের বিধানে
সম্পূর্ণভাবে হারাম বা অবৈধ।
যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে তিনি
বলেন, রাষ্ট্রের আইনে যদি কারো অপরাধ প্রমাণিত হয় তাহলে রাষ্ট্র আইন
অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সেখানে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। ইসলামেও
তাই বলা হয়েছে।