ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ছিলেন হযরত নূহ
(আঃ)-এর সম্ভবত: এগারোতম অধঃস্তন পুরুষ। নূহ থেকে ইবরাহীম পর্যন্ত প্রায়
২০০০ বছরের ব্যবধান ছিল। হযরত ছালেহ (আঃ)-এর প্রায় ২০০ বছর পরে ইবরাহীমের
আগমন ঘটে। ঈসা থেকে ব্যবধান ছিল ১৭০০ বছর অথবা প্রায় ২০০০ বছরের। তিনি
ছিলেন ‘আবুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের পিতা এবং তাঁর স্ত্রী ‘সারা’ ছিলেন
‘উম্মুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের মাতা। তাঁর স্ত্রী সারার পুত্র হযরত
ইসহাক্ব-এর পুত্র ইয়াকূব (আঃ)-এর বংশধর ‘বনু ইসরাঈল’ নামে পরিচিত এবং অপর
স্ত্রী হাজেরার পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে জন্ম নেন বিশ্বনবী ও শেষনবী
হযরত মুহাম্মাদ(ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। যাঁর অনুসারীগণ
‘উম্মতে মুহাম্মাদী’ বা ‘মুসলিম উম্মাহ’ বলে পরিচিত।
বাবেল হ’তে তিনি কেন‘আনে (ফিলিস্তীন)
হিজরত করেন। সেখান থেকে বিবি সারা-র বংশজাত নবীগণের মাধ্যমে আশপাশে সর্বত্র
তাওহীদের দাওয়াত বিস্তার লাভ করে। অপর স্ত্রী হাজেরার পুত্র ইসমাঈলের
মাধ্যমে বায়তুল্লাহ ও তার আশপাশ এলাকায় তাওহীদের প্রচার ও প্রসার হয় এবং
অবশেষে এখানেই সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমন ঘটে। এভাবে
ইবরাহীমের দুই স্ত্রীর বংশজাত নবীগণ বিশ্বকে তাওহীদের আলোয় আলোকিত করেন।
শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দেহসৌষ্ঠব ও চেহারা মুবারক পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর
ন্যায় ছিল। যা তিনি মে‘রাজ থেকে ফিরে এসে উম্মতকে খবর দেন।
জ্ঞানীদের ইশারাই যথেষ্ট। কিন্তু মানুষ
যখন কোন কিছুর প্রতি অন্ধভক্তি পোষণ করে, তখন শত যুক্তিও কোন কাজ দেয় না।
ফলে ইবরাহীম ভাবলেন, এমন কিছু একটা করা দরকার, যাতে পুরা সমাজ নড়ে ওঠে ও
ওদের মধ্যে হুঁশ ফিরে আসে। সাথে সাথে তাদের মধ্যে তাওহীদী চেতনার উন্মেষ
ঘটে। সেমতে তিনি সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় দেবমন্দিরে গিয়ে মূর্তিগুলো ভেঙ্গে
ফেলার সংকল্প করলেন।
ইবরাহীম (আঃ)-এর সম্প্রদায় বছরের একটা
বিশেষ দিনে উৎসব পালন করত ও সেখানে নানারূপ অপচয় ও অশোভন কাজ করত। যেমন
আজকাল প্রবৃত্তি পূজারী ও বস্ত্তবাদী লোকেরা করে থাকে কথিত সংস্কৃতির নামে।
এইসব মেলায় সঙ্গত কারণেই কোন নবীর যোগদান করা সম্ভব নয়। কওমের লোকেরা তাকে
উক্ত মেলায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানালো। কিন্তু তিনি অসুস্থতার অজুহাত
দেখিয়ে সেখানে যেতে অপারগতা প্রকাশ করলেন (ছাফফাত ৩৭/৮৯)। অতঃপর তিনি
ভাবলেন, আজকের এই সুযোগে আমি ওদের দেবমন্দিরে প্রবেশ করে মূর্তিগুলোকে
ভেঙ্গে চুরমার করে দেব। যাতে ওরা ফিরে এসে ওদের মিথ্যা উপাস্যদের
অসহায়ত্বের বাস্তব দৃশ্য দেখতে পায়। হয়তবা এতে তাদের অনেকের মধ্যে হুঁশ
ফিরবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান জাগ্রত হবে ও শিরক থেকে তওবা করবে।
অতঃপর তিনি দেবালয়ে ঢুকে পড়লেন ও
দেব-দেবীদের দিকে লক্ষ্য করে বললেন, (তোমাদের সামনে এত নযর-নেয়ায ও
ভোগ-নৈবেদ্য রয়েছে)। অথচ ‘তোমরা তা খাচ্ছ না কেন? কি ব্যাপার তোমরা কথা বলছ
না কেন? তারপর তিনি ডান হাতে রাখা (সম্ভবতঃ কুড়াল দিয়ে) ভীষণ জোরে আঘাত
করে সবগুলোকে গুঁড়িয়ে দিলেন (ছাফফাত ৩৭/৯১-৯৩)। তবে বড় মূর্তিটাকে
পূর্বাবস্থায় রেখে দিলেন, যাতে লোকেরা তার কাছে ফিরে যায় (আম্বিয়া ২১/৫৮)।
মেলা শেষে লোকজন ফিরে এল এবং যথারীতি
দেবমন্দিরে গিয়ে প্রতিমাগুলির অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে গেল। ‘তারা বলাবলি
করতে লাগল, এটা নিশ্চয়ই ইবরাহীমের কাজ হবে। কেননা তাকেই আমরা সবসময় মূর্তি
পূজার বিরুদ্ধে বলতে শুনি। অতঃপর ইবরাহীমকে সেখানে ডেকে আনা হ’ল এবং
জিজ্ঞেস করল, ‘হে ইবরাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ আচরণ
করেছ’? (আম্বিয়া ২১/৬২)।
ইবরাহীম বললেন, ‘বরং এই বড় মূর্তিটাই একাজ
করেছে। নইলে এদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তারা কথা বলতে পারে’ (আম্বিয়া ২১/৬৩)।
সম্প্রদায়ের নেতারা একথা শুনে লজ্জা পেল এবং মাথা নীচু করে বলল, ‘তুমি তো
জানো যে, এরা কথা বলে না’। ‘তিনি বললেন, ‘তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে এমন
কিছুর ইবাদত কর, যা তোমাদের উপকারও করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না’
(আম্বিয়া ২১/৬৫-৬৬)। তিনি আরও বললেন,‘তোমরা এমন বস্ত্তর পূজা কর, যা তোমরা
নিজ হাতে তৈরী কর’? ‘অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে ও তোমাদের কর্মসমূহকে সৃষ্টি
করেছেন’ (ছাফফাত ৩৭/৯৫-৯৬)।‘ধিক তোমাদের জন্য এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমরা
যাদের পূজা কর, ওদের জন্য। তোমরা কি বুঝ না’? (আম্বিয়া ২১/৬৭)।
তারপর যা হবার তাই হ’ল। যিদ ও অহংকারের
বশবর্তী হয়ে সম্প্রদায়ের নেতারা ইবরাহীমকে চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়ার পরিকল্পনা
করল। তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, একে আর বাঁচতে দেওয়া যাবে না। শুধু তাই নয়,
একে এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে মারতে হবে, যেন কেউ এর দলে যেতে সাহস না
করে। তারা তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার প্রস্তাব গ্রহণ করল এবং সেটা বাদশাহ
নমরূদের কাছে পেশ করল। সম্রাটের মন্ত্রী ও দেশের প্রধান পুরোহিতের ছেলে
ইবরাহীম। অতএব তাকে সরাসরি সম্রাটের দরবারে আনা হ’ল।
<a
href='http://ritsllc.com/ads/server/adserve/www/delivery/ck.php?n=a1a091d0&amp;cb=INSERT_RANDOM_NUMBER_HERE'
target='_blank'><img
src='http://ritsllc.com/ads/server/adserve/www/delivery/avw.php?zoneid=354&amp;cb=INSERT_RANDOM_NUMBER_HERE&amp;n=a1a091d0'
border='0' alt=''/></a>
নমরূদের সঙ্গে বিতর্ক ও অগ্নিপরীক্ষা :
ইবরাহীম (আঃ) এটাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে
তাওহীদের দাওয়াত দেওয়ার সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করলেন। নমরূদ ৪০০ বছর ধরে
রাজত্ব করায় সে উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে উঠেছিল এবং নিজেকে একমাত্র উপাস্য
ভেবেছিল। তাই সে ইবরাহীমকে জিজ্ঞেস করল, বল তোমার উপাস্য কে? নমরূদ
ভেবেছিল, ইবরাহীম তাকেই উপাস্য বলে স্বীকার করবে। কিন্তু নির্ভীক কণ্ঠে
ইবরাহীম জবাব দিলেন, ‘আমার পালনকর্তা তিনি, যিনি মানুষকে বাঁচান ও মারেন’।
মোটাবুদ্ধির নমরূদ বলল, ‘আমিও বাঁচাই ও মারি’। অর্থাৎ মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত
আসামীকে খালাস দিয়ে মানুষকে বাঁচাতে পারি। আবার খালাসের আসামীকে মৃত্যুদন্ড
দিতে পারি। এভাবে সে নিজেকেই মানুষের বাঁচা-মরার মালিক হিসাবে সাব্যস্ত
করল। ইবরাহীম তখন দ্বিতীয় যুক্তি পেশ করে বললেন, ‘আমার আল্লাহ সূর্যকে
পূর্ব দিক থেকে উদিত করেন, আপনি তাকে পশ্চিম দিক হ’তে উদিত করুন’। ‘অতঃপর
কাফের (নমরূদ) এতে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো’ (বাক্বারাহ ২/২৫৮)।
কওমের নেতারাই যেখানে পরাজয়কে মেনে নেয়নি,
সেখানে দেশের একচ্ছত্র সম্রাট কেন পরাজয়কে মেনে নিবেন। যথারীতি তিনিও
অহংকারে ফেটে পড়লেন এবং ইবরাহীমকে জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার
নির্দেশ জারি করলেন। সাথে সাথে জনগণকে ধর্মের দোহাই দিয়ে বললেন, ‘তোমরা একে
পুড়িয়ে মার এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও’
(আম্বিয়া ২১/৬৮)। উল্লেখ্য যে, কুরআন কোথাও নমরূদের নাম উল্লেখ করেনি এবং
সে যে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ উপাস্য’ দাবী করেছিল, এমন কথাও স্পষ্টভাবে বলেনি।
তবে ‘আমিও বাঁচাতে পারি ও মারতে পারি’ (বাক্বারাহ ২/২৫৮) তার এই কথার মধ্যে
তার সর্বোচ্চ অহংকারী হবার এবং ইবরাহীমের ‘রব’-এর বিপরীতে নিজেকে এভাবে
উপস্থাপন করায় সে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ রব’ হিসাবে ধারণা করেছিল বলে প্রতীয়মান
হয়। প্রধানত: ইস্রাঈলী বর্ণনাসমূহের উপরে ভিত্তি করেই ‘নমরূদ’-এর নাম ও তার
রাজত্ব সম্পর্কে জানা যায়। কুরআন কেবল অতটুকুই বলেছে, যতটুকু মানব জাতির
হেদায়াতের জন্য প্রয়োজন।
যুক্তিতর্কে হেরে গিয়ে নমরূদ ইবরাহীম
(আঃ)-কে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার হুকুম দিল। অতঃপর তার জন্য বিরাটাকারের আয়োজন
শুরু হয়ে গেল। আল্লাহ বলেন, ‘তারা ইবরাহীমের বিরুদ্ধে মহা ফন্দি অাঁটতে
চাইল। অতঃপর আমরা তাদেরকেই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম’ (আম্বিয়া
২১/৭০)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তাদেরকে পরাভূত করে দিলাম’ (ছাফফাত
৩৭/৯৮)।
অতঃপর ‘একটা ভিত নির্মাণ করা হ’ল এবং
সেখানে বিরাট অগ্নিকুন্ড তৈরী করা হ’ল। তারপর সেখানে তাকে নিক্ষেপ করা হ’ল’
(ছাফফাত ৩৭/৯৭)। ছহীহ বুখারীতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে
বর্ণিত হয়েছে যে, জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপের সময় ইবরাহীম (আঃ) বলে
ওঠেন, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’।[9]
একই প্রার্থনা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)
করেছিলেন, ওহোদ যুদ্ধে আহত মুজাহিদগণ যখন শুনতে পান যে, আবু সুফিয়ান মক্কায়
ফিরে না গিয়ে পুনরায় ফিরে আসছে মদীনায় মুসলিম শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার
জন্য, তখন ‘হামরাউল আসাদে’ উপনীত তার পশ্চাদ্ধাবনকারী ৭০ জন আহত ছাহাবীর
ক্ষুদ্র দল রাসূলের সাথে সমস্বরে বলে উঠেছিল ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’ ঘটনাটি কুরআনেও বর্ণিত হয়েছে’। এভাবে
পিতা ইবরাহীম ও পুত্র মুহাম্মাদের বিপদ মুহূর্তের বক্তব্যে শব্দে শব্দে মিল
হয়ে যায়। তবে সার্বিক প্রচেষ্টার সাথেই কেবল উক্ত দো‘আ পাঠ করতে হবে। নইলে
কেবল দো‘আ পড়ে নিষ্ক্রিয় বসে থাকলে চলবে না। যেমন ইবরাহীম (আঃ) সর্বোচ্চ
পর্যায়ে দাওয়াত দিয়ে চূড়ান্ত বিপদের সময় এ দো‘আ করেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বিরোধী পক্ষের সেনাপতি আবু সুফিয়ানের পশ্চাদ্ধাবনের পরেই উক্ত দো‘আ
পড়েছিলেন।
বস্ত্ততঃ এই কঠিন মুহূর্তের পরীক্ষায়
জয়লাভ করার পুরস্কার স্বরূপ সাথে সাথে আল্লাহর নির্দেশ এল ‘হে আগুন! ঠান্ডা
হয়ে যাও এবং ইবরাহীমের উপরে শান্তিদায়ক হয়ে যাও’ (আম্বিয়া ২১/৬৯)। অতঃপর
ইবরাহীম মুক্তি পেলেন।
অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইবরাহীম (আঃ)
ফিরে আসেন এবং এভাবে আল্লাহ কাফিরদের সমস্ত কৌশল বরবাদ করে দেন। এরপর শুরু
হ’ল জীবনের আরেক অধ্যায়।
No comments:
Post a Comment